রক্ত জীবনীশক্তির মূল। রক্তনালির মধ্য দিয়ে রক্ত দেহের সর্বত্র প্রবাহিত হয় এবং কোষে অক্সিজেন ও খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে। ফলে দেহের সব কোষ সজীব এবং সক্রিয় থাকে। যে তন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত প্রতিনিয়ত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও অংশে চলাচল করে, তাকে রক্ত সংবহনতন্ত্র বলে। এ তন্ত্রে প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমেই খাদ্য, অক্সিজেন এবং রক্তের বর্জ্য পদার্থ দেহের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবাহিত হয়।
মানবদেহে রক্তপ্রবাহ কেবল হৃৎপিন্ড এবং রক্তনালিগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কখনো এর বাইরে আসে না। এ ধরনের সংবহনতন্ত্রকে বদ্ধ সংবহনতন্ত্র (Close circulatory system) বলা হয়। সারা দেহে রক্ত একবার সম্পূর্ণ পরিভ্রমণের জন্য মাত্র এক মিনিট বা তার চেয়েও কম সময় লাগে। বদ্ধ সংবহনতন্ত্রের বড় সুবিধা হলো এ ব্যবস্থায়,
(a) রক্ত সরাসরি দেহের বিভিন্ন অঙ্গে গিয়ে পৌঁছে।
(b) রক্তবাহী নালির ব্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে দেহ কোনো বিশেষ অঙ্গে রক্তপ্রবাহের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।(c) রক্ত বিভিন্ন অঙ্গে পরিভ্রমণ করে দ্রুত হৃৎপিন্ডে ফিরে আসে।
অন্যান্য তন্ত্রের তুলনায় রুন্ত সংবহনতন্ত্র বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হলেও এর গঠনশৈলী মোটামুটি সাধারণ।
পরিবহনতন্ত্রকে সাধারণত দুটি অংশে ভাগ করা হয়, রক্ত সংবহনতন্ত্র (Blood circulatory system): হৃৎপিন্ড, ধমনি, শিরা ও কৈশিকনালি নিয়ে গঠিত এবং লসিকাতন্ত্র (Lymphatic system): লসিকা, লসিকানালি ও ল্যাকটিয়েলনালি নিয়ে পঠিত।
রম্ভ একটি অস্বচ্ছ, মৃদু ক্ষারীয় এবং লবণান্ত তরল পদার্থ। রস্ত হৃৎপিন্ড, শিরা, উপশিরা, ধমনি, শাখা ধমনি এবং কৈশিকনালি পথে আবর্তিত হয়। লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ থাকার কারণে রপ্তের রং লাল দেখায়। হাড়ের লাল অস্থিমজ্জাতে রক্তকণিকার জন্ম হয়।
রক্তের উপাদান
রক্ত এক ধরনের তরল যোজক কলা। রক্তরস এবং কয়েক ধরনের রক্তকণিকার সমন্বয়ে রক্ত গঠিত।
(a) রক্তরস (Plasma):
রক্তের বর্ণহীন তরল অংশকে রক্তরস বলে। সাধারণত রক্তের শতকরা প্রায় 55 ভাগ রপ্তরস। রক্তরসের প্রধান উপাদান পানি। এছাড়া বাকি অংশে কিছু প্রোটিন, জৈবযৌগ ও সামান্য অজৈব লবণ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। এর মধ্যে যে- পদার্থগুলো থাকে তা হলো:
(i) প্রোটিন, যথা-অ্যালবুমিন, গ্লোবিউলিন ও ফাইব্রিনোজেন
(ii) গ্লুকোজ
(iii) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর্বিকণা
(iv) খনিজ লবণ
(v) ভিটামিন
(vi) হরমোন
(vii) এন্টিবডি
(viii) বর্জ্য পদার্থ যেমন: কার্বন ডাই-অক্সাইড, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড ইত্যাদি।
এছাড়া সামান্য পরিমাণে সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম বাইকার্বোনেট ও অ্যামাইনো এসিড থাকে। আমরা খাদ্য হিসেবে যা গ্রহণ করি তা পরিপাক হয়ে অন্ত্রের পাত্রে শোষিত হয় এবং রক্তরসে মিশে দেহের সর্বত্র সঞ্চালিত হয়। এভাবে দেহকোষগুলো পুষ্টিকর দ্রব্যাদি গ্রহণ করে দেহের পুষ্টির সাধন এবং ক্ষয়পূরণ করে।
(b) রক্তকণিকা (Blood corpuscles)
মানবদেহে তিন ধরনের রক্তকণিকা দেখা যায়, লোহিত রক্তকণিকা (Red Blood Corpuscles), শ্বেত রক্তকণিকা (White Blood Corpuscles) এবং অণুচক্রিকা (Blood Platelets)। যদিও এগুলো সব
কোষ, তবে রস্তের প্লাজমার মধ্যে ভাসমান কণার সাথে তুলনা করে এদেরকে অনেক দিন আগে রক্তকণিকা নাম দেওয়া হয়েছিল, তখন অণুবীক্ষণ যন্ত্র এখনকার মতো উন্নত ছিল না। সেই নাম এখনও প্রচলিত।
(1) লোহিত রুস্তকণিকা: মানবদেহে তিন ধরনের রক্তকণিকার মধ্যে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এটি শ্বাসকার্যে অক্সিজেন পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লাল অস্থিমজ্জায় লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হয়। এর গড় আয়ু 120 দিন। মানুষের লোহিত রক্তকণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে না এবং দেখতে অনেকটা দ্বি-অবতল বৃত্তের মতো। পূর্ণবয়স্ক ব্যপ্তির রস্ত্রে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে প্রায় 50 লক্ষ।এটি শ্বেত রক্তকণিকার চেয়ে প্রায় 500 পুণ বেশি। পুরুষের তুলনায় নারীদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা কম থাকে। তুলনামূলকভাবে শিশুদের দেহে লোহিত রুস্তকণিকার পরিমাণ বেশি থাকে। আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়, আবার সমপরিমাণে তৈরিও হয়। লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন অক্সিহিমোগ্লোবিন হিসেবে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহন করে।
হিমোগ্লোবিন: হিমোগ্লোবিন এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ। লোহিত রক্তকণিকায় এর উপস্থিতির কারণে রক্ত লাল দেখায়। রক্তে প্রয়োজনীয় পরিমাণ হিমোগ্লোবিন না থাকলে রক্তস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতা (anemia) দেখা দেয়। বাংলাদেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী এ রোগে আক্রান্ত।
(ii) শ্বেত রক্তকণিকা বা লিউকোসাইট
শ্বেত রক্তকণিকার নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। এগুলো হিমোগ্লোবিনবিহীন এবং নিউক্লিয়াসযুক্ত বড় আকারের কোষ। শ্বেত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১-১৫ দিন। হিমোগ্লোবিন না থাকার কারণে এদের শ্বেত রক্তকণিকা, ইংরেজিতে White Blood Cell বা WBC বলে। শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা RBC-এর তুলনায় অনেক কম। এরা অ্যামিবার মতো দেহের আকারের পরিবর্তন করে। ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় এটি জীবাণুকে ধ্বংস করে।
শ্বেত রক্তকণিকাগুলো রন্তরসের মধ্য দিয়ে নিজেরাই চলতে পারে। রক্ত জালিকার প্রাচীর ভেদ করে টিস্যুর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। দেহ বাইরের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে, দ্রুত শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। মানবদেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রপ্তে 4-10 হাজার শ্বেত রক্তকণিকা থাকে। অসুস্থ মানবদেহে এর সংখ্যা বেড়ে যায়। স্তন্যপায়ীদের রক্তকোষগুলোর মধ্যে শুধু শ্বেত রক্তকণিকায় DNA থাকে।
প্রকারভেদ: গঠনগতভাবে এবং সাইটোপ্লাজমে দানার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি অনুসারে শ্বেত রক্ত কণিকাকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যায়, যথা (ক) অ্যাপ্রানুলোসাইট বা দানাবিহীন এবং (খ) প্রানুলোসাইট বা দানাযুক্ত।
(ক) অ্যাগ্রানুলোসাইট: এ ধরনের শ্বেত রক্তকণিকার
সাইটোপ্লাজম দানাহীন ও স্বচ্ছ। অ্যাগ্রানুলোসাইট শ্বেত রক্তকণিকা দুরকমের; যথা-লিম্ফোসাইট ও মনোসাইট। দেহের লিম্ফনোড, টনসিল, প্লিহা ইত্যাদি অংশে এরা তৈরি হয়। লিম্ফোসাইটগুলো বড় নিউক্লিয়াসযুক্ত ছোট কণিকা। মনোসাইট ছোট, ডিম্বাকার ও বৃক্কাকার নিউক্লিয়াসবিশিষ্ট বড় কণিকা। লিম্ফোসাইট অ্যান্টিবডি গঠন করে এবং এই অ্যান্টিবডির দ্বারা দেহে প্রবেশ করা রোগজীবাণু ধ্বংস করে। এভাবে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মনোসাইট ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় রোগজীবাণুকে ধ্বংস করে।
(খ) প্রানুলোসাইট:
এদের সাইটোপ্লাজম সুক্ষ্ম দানাযুক্ত। প্রানুলোসাইট শ্বেত রক্তকণিকাগুলো নিউক্লিয়াসের আকৃতির ভিত্তিতে তিন প্রকার যথা: নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল এবং বেসোফিল।
নিউট্রোফিল ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ করে। ইওসিনোফিল ও বেসোফিল হিস্টামিন নামক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে দেহে এলার্জি প্রতিরোধ করে। বেসোফিল হেপারিন নিঃসৃত করে রস্তুকে রন্তবাহিকার ভিতরে জমাট বাঁধতে বাধা দেয়।
(iii) অণুচক্রিকা বা প্রম্বোসাইট
ইংরেজিতে এদেরকে প্লেইটলেট (Platelet) বলে। এগুলো গোলাকার, ডিম্বাকার অথবা রড আকারের হতে পারে। এদের সাইটোপ্লাজম দানাদার এবং সাইটোপ্লাজমে কোষ অঙ্গাণু- মাইটোকন্ড্রিয়া, গল্পি বন্ধু থাকে; কিন্তু নিউক্লিয়াস থাকে না। অনেকের মতে, অণুচক্রিকাগুলো সম্পূর্ণ কোষ নয়; এগুলো অস্থি মজ্জার বৃহদাকার কোষের ছিন্ন অংশ। অণুচক্রিকাগুলোর গড় আয়ু ৫-১০ দিন। পরিণত মানবদেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। অসুস্থ দেহে এদের সংখ্যা আরও বেশি হয়।
অণুচক্রিকার প্রধান কাজ হলো রক্ত তঞ্চন করা বা জমাট বাঁধানোতে (blood clotting) সাহায্য করা। যখন কোনো রক্তবাহিকা বা কোনো টিস্যু আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কেটে যায়, তখন সেখানকার অণুচক্রিকাগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে অনিয়মিত আকার ধারণ করে এবং থ্রোম্বোপ্লাসটিন (Thromboplastin) নামক পদার্থ তৈরি করে। এ পদার্থগুলো রন্দ্রের প্রোটিন প্রোগ্রোম্বিনকে প্রোখিনে পরিণত করে। ব্রোমিন পরবর্তী সময়ে রক্তরসের প্রোটিন-ফাইব্রিনোজেনকে ফাইব্রিন জালকে পরিণত করে রক্তকে জমাট বাধায় কিংবা রস্তের তঞ্চন ঘটায়। ফাইব্রিন একধরনের অদ্রবণীয় প্রোটিন, যা দ্রুত সুতার মতো জালিকা প্রস্তুত করে। এটি ক্ষত স্থানে জমাট বাঁধে এবং রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। তবে রক্ত তঞ্চন প্রক্রিয়াটি আরও জটিল, এ প্রক্রিয়ায় জন্য আরও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এবং ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম আয়ন জড়িত থাকে।
রক্তে উপযুক্ত পরিমাণ অণুচক্রিকা না থাকলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। ফলে অনেক সময় রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।
রক্তের কাজ
রক্ত দেহের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি দেহের নানাবিধ কাজ করে, যেমন:
(a) অক্সিজেন পরিবহন: লোহিত রক্তকণিকা অক্সিহিমোগ্লোবিনরূপে কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে।
(b) কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ: রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে কোষগুলোতে যে কার্বন ডাই- অক্সাইড উৎপন্ন হয়, রক্তরস সোডিয়াম বাই কার্বনেটরূপে তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে এবং নিঃশ্বাস বায়ুর সাথে ফুসফুসের সাহায্যে দেহের বাইরে বের করে দেয়।
(c) খাদ্যসার পরিবহন: রক্তরস গ্লুকোজ, অ্যামাইনো এসিড, চর্বিকণা ইত্যাদি কোষে সরবরাহ করে।
(d) তাপের সমতা রক্ষা: দেহের মধ্যে অনবরত দহনক্রিয়া সম্পাদিত হচ্ছে। এতে করে বিভিন্ন
অঙ্গে বিভিন্ন মাত্রার তাপ সৃষ্টি হয় এবং তা রক্তের মাধ্যমে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে দেহের সর্বত্র তাপের সমতা রক্ষা হয়।
(e) বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন: রক্ত দেহের জন্য ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ বহন করে এবং বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে সেসব ইউরিয়া, ইউরিক এসিড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড হিসেবে নিষ্কাশন করে।
(f) হরমোন পরিবহন: হরমোন নালিবিহীন গ্রন্থিতে তৈরি এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ বা রস। এই রস সরাসরি রক্তে মিশে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্গে সঞ্চালিত হয় এবং বিভিন্ন জৈবিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(g) রোগ প্রতিরোধ: কয়েক প্রকারের শ্বেত রক্তকণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় দেহকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন উৎপাদনের মাধ্যমে রক্ত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
(h) রক্ত জমাট বাঁধা: দেহের কোনো অংশ কেটে গেলে অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং দেহের রক্তক্ষরণ বন্ধ করে।
একজন আশঙ্কাজনক বা মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন, তার রক্তের গ্রুপ 'বি' পজিটিভ। তোমরা এ রকম বিজ্ঞাপন প্রায়শই টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাও। রক্তের গ্রুপ বা ব্লাড গ্রুপ কী? কেনইবা ব্লাড গ্রুপ জানা প্রয়োজন? অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে বিভিন্ন ব্যক্তির লোহিত রক্ত কণিকায় A এবং B নামক দুই ধরনের অ্যান্টিজেন (antigens) থাকে এবং রক্তরসে a ও b দুধরনের অ্যান্টিবডি (antibody) থাকে। এই অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে মানুষের রক্তকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা যায়। একে ব্লাড গ্রুপ বলে। বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার 1901 সালে মানুষের রক্তের শ্রেণিবিন্যাস করে তা A, B, AB এবং ০- এ চারটি গ্রুপের নামকরণ করেন। সাধারণত একজন মানুষের রক্তের গ্রুপ আজীবন একই রকম থাকে।
নিচের সারণিতে রক্তের গ্রুপের অ্যান্টিবডি এবং অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি দেখানো হলো:
আমরা উপরের সারণিতে রস্তে বিভিন্ন অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখেছি। এর ভিত্তিতে আমরা ব্লাড গ্রুপকে এভাবে বর্ণনা করতে পারি। যেমন:
গ্রুপ A: এ শ্রেণির রন্দ্রে এ অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টি-B অ্যান্টিবডি (সংক্ষেপে B অ্যান্টিবডি) থাকে।
গ্রুপ B: এ শ্রেণির রন্তে ও অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টি-এ অ্যান্টিবডি (সংক্ষেপে এ অ্যান্টিবডি) থাকে।
গ্রুপ AB: এই শ্রেণির রস্তে A ও B অ্যান্টিজেন থাকে এবং কোনো অ্যান্টিবডি থাকে না।
গ্রুপ ০: এ শ্রেণির রক্তে কোনো অ্যান্টিজেন থাকে না কিন্তু a ও B অ্যান্টিবডি থাকে।
দাতার লোহিত কণিকা বা কোষের কোষঝিল্লিতে উপস্থিত অ্যান্টিজেন যদি প্রহীতার রক্তরসে উপস্থিত এমন অ্যান্টিবডির সংস্পর্শে আসে, যা উন্তু অ্যান্টিজেনের সাথে বিক্রিয়া করতে সক্ষম তাহলে, অ্যান্টিজেন- অ্যান্টিবডি বিক্রিয়া হয়ে গ্রহীতা বা রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এজন্য সব গ্রুপের রক্ত সবাইকে দেওয়া যায় না। যেমন: তোমার রক্তের গ্রুপ যদি হয় এ (অর্থাৎ লোহিত কণিকার ঝিল্লিতে এ অ্যান্টিজেন আছে) এবং তোমার বন্ধুর রন্তের গ্রুপ যদি B হয় (অর্থাৎ রক্তরসে এ অ্যান্টিবডি আছে) তাহলে তুমি তোমার বন্ধুকে রক্ত দিতে পারবে না। যদি দাও তাহলে তোমার এ অ্যান্টিজেন তোমার বন্ধুর a অ্যান্টিবডির সাথে বিক্রিয়া করে বন্ধুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই দাতার রস্তে যে অ্যান্টিজেন থাকে তার সাথে মিলিয়ে এমনভাবে প্রহীতা নির্বাচন করতে হয় যেন তার রক্তে দাতার অ্যান্টিজেনের সাথে সম্পর্কিত অ্যান্টিবডিটি না থাকে। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে কোন গ্রুপ কাকে রক্ত দিতে পারবে বা পারবে না, তার একটা ছক বানানো যায়।
উপরের সারণিটি লক্ষ করলে দেখতে পারবে ০ গ্রুপের রক্তবিশিষ্ট ব্যক্তি সব গ্রুপের রক্তের ব্যক্তিকে রক্ত দিতে পারে। এদের বলা হয় সর্বজনীন রক্তদাতা (universal donor)। AB রক্তধারী ব্যক্তি যেকোনো ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করতে পারে। তাই তাকে সর্বজনীন রক্তগ্রহীতা (universal recipient) বলা হয়।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সর্বজনীন রক্তদাতা কিংবা সর্বজনীন রক্তগ্রহীতার ধারণা খুব একটা প্রযোজ্য নয়। কেননা, রক্তকে অ্যান্টিজেনের ভিত্তিতে শ্রেণিকরণ করার ক্ষেত্রে ABO পদ্ধতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও রক্তে আরও অসংখ্য অ্যান্টিজেন থাকে, যেগুলো ক্ষেত্রবিশেষে অসুবিধার কারণ হতে পারে। যেমন: রেসাস (Rh) ফ্যাক্টর, যা এক ধরনের অ্যান্টিজেন। কারো রক্তে এই ফ্যাক্টর উপস্থিত থাকলে তাকে বলে পজিটিভ আর না থাকলে বলে নেগেটিভ। এটি যদি না মেলে তাহলেও গ্রহীতা বা রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তাই ABO গ্রুপের পাশাপাশি রেসাস ফ্যাক্টরও পরীক্ষা করে মিলিয়ে দেখা চাই। অর্থাৎ রেসাস ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় নেওয়া হলে রক্তের গ্রুপগুলো হবে A+, A-, B+ B-, AB+, AB-, O+ এবং ০-। নেগেটিভ গ্রুপের রক্তে যেহেতু রেসাস ফ্যাক্টর অ্যান্টিজেন নেই, তাই এটি পজিটিভ গ্রুপকে দেওয়া যাবে কিন্তু পজিটিভ গ্রুপের রক্ত নেগেটিভ গ্রুপকে দেওয়া যাবে না। এছাড়া রক্তে আরও অনেকগুলো অ্যান্টিজেনভিত্তিক গৌণ গ্রুপ (minor blood group) থাকায় রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে ABO গ্রুপিং এবং Rh টাইপিং এর পাশাপাশি ক্রস ম্যাচিং (cross matching) নামক একটি পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক যাতে গৌণ গ্রুপসমূহের কারণে জটিলতার সৃষ্টি না হয়। তাছাড়া, রক্ত গ্রহীতা যেন জীবাণুঘটিত মারাত্মক রোগের (যেমন: এইডস, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি ইত্যাদি) সংক্রমণের শিকার না হয় সেটি নিশ্চিত করতে দাতার রক্তের স্ক্রিনিং পরীক্ষা (screening test) করাটাও জরুরি।
রক্তদান ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
আঘাত, দুর্ঘটনা, শল্যচিকিৎসা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে অত্যধিক রক্তক্ষরণ হলে দেহে রক্তের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। রক্তশূন্যতা দূর করার জন্য ঐ ব্যক্তির দেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তশূন্যতা দূর করার জন্য রোগীর দেহে অন্য মানুষের রক্ত দিতে হয়। অন্যকে রক্তদান করা বর্তমানে একটি সাধারণ ঘটনা। জরুরি অবস্থায় অন্য ব্যক্তির রক্ত সরাসরি বা ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করা রক্ত রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়। কোনো ব্যক্তির শিরার মধ্য দিয়ে বাইরে থেকে অন্যের রক্ত প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াকে রক্ত সঞ্চালন (Blood transfusion) বলে। এটি একটি চমৎকার ফলপ্রদ ব্যবস্থা, যার ফলে রোগীর প্রাণ রক্ষা হয়। তবে কোনো অবস্থাতেই রোগীর রক্তের গ্রুপ ও প্রকৃতি পরীক্ষা না করে এক রোগীর দেহে অন্য কোনো ব্যক্তির বা ব্লাড ব্যাংকে রক্ষিত রক্ত প্রবেশ করানো উচিত নয়। ব্যতিক্রম হলে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়ে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে বেড়ে যায়। যেমন: রক্তকণিকাগুলোর জমাট বাঁধা, বিশ্লিষ্ট হওয়া, জন্ডিসের প্রাদুর্ভাব এবং প্রস্রাবের সাথে হিমোগ্লোবিন নির্গত হওয়া ইত্যাদি।
আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন হয়। মনে রাখতে হবে, এটি আমাদের সবার জন্য একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। যেহেতু রক্তের কোনো বিকল্প নেই, তাই এরূপ অবস্থায় অনেক সময় প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয় এবং অন্যের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে ঐ জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়। এরূপ জরুরি পরিস্থিতিতে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়।
অন্যকে রক্তদান করা একটি মহৎ কাজ। এতে রক্তদাতার নিজের কোনো ক্ষতি হয় না। একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে 450 মিলি রক্ত বের করে দিলে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। তার দেহ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় 20 লক্ষ লোহিত রক্তকণিকা সৃষ্টি করতে পারে। দেখা গেছে, কোনো সুস্থ ব্যক্তি চার মাস পর পর রক্তদান করলে দাতার দেহে সামান্যতম কোনো অসুবিধা হয় না।
বর্তমানে রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণে নানা রকম কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। যেমন: কোনো বিশেষ দিবসে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন। এতে জনসাধারণের মাঝে রক্তদান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও ভীতি অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। অতীতের তুলনায় মানুষ এখন রক্তদান এবং গ্রহণ সম্পর্কে অধিক আগ্রহী ও সচেতন।
6.4.1 হৃৎপিণ্ডের গঠন
হৃৎপিণ্ড বক্ষ গহ্বরের বাম দিকে দুই ফুসফুসের মাঝখানে অবস্থিত একটি ত্রিকোণাকার ফাঁপা অঙ্গ। এটি হৃৎপেশি নামক এক বিশেষ ধরনের অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে গঠিত। হৃৎপিণ্ড পেরিকার্ডিয়াম নামক পাতলা পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। হৃৎপিণ্ড-প্রাচীরে থাকে তিনটি স্তর, বহিঃস্তর বা এপিকার্ডিয়াম, মধ্যস্তর বা মায়োকার্ডিয়াম এবং অন্তঃস্তর বা এন্ডোকার্ডিয়াম।
বহিঃস্তর (Epicardium): এটি মূলত যোজক কলা নিয়ে গঠিত। এই স্তরটিতে বিক্ষিপ্তভাবে চর্বি থাকে এবং এটি আবরণী কলা দিয়ে আবৃত।
মধ্যস্তর (Myocardium): এটি বহিঃস্তর এবং অন্তঃস্তরের মাঝখানে অবস্থান করে। দৃঢ় অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে এ স্তর গঠিত।
অন্তঃস্তর (Endocardium): এটি সবচেয়ে ভিতরের স্তর। হৃৎপিন্ডের প্রকোষ্ঠগুলো অন্তঃস্তর দিয়ে
আবৃত। এই স্তরটি হৃৎপিন্ডের কপাটিকাগুলোকেও আবৃত করে রাখে। হৃৎপিন্ডের ভিতরের স্তর ফাঁপা এবং চারটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। উপরের প্রকোষ্ঠ দুটি নিচের দুটির চেয়ে আকারে ছোট। উপরের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান এবং বাম অলিন্দ (right & left atrium) বলে এবং নিচের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান এবং বাম নিলয় (right & left ventricle) বলে। অলিন্দ দুটির প্রাচীর তুলনামূলকভাবে পাতলা, আর নিলয়ের প্রাচীর পুরু। অলিন্দ এবং নিলয় যথাক্রমে আন্তঃঅলিন্দ পর্দা এবং আন্তঃনিলয় পর্দা দিয়ে পরস্পর পৃথক থাকে।
common.read_more